নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::
কক্সবাজারের চকরিয়ায় দুইদফা ভয়াবহ বন্যায় লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া গ্রামীণ অবকাঠামো দিয়ে সড়ক যোগাযোগ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন একাধিক সড়ক থাকলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) রয়েছে ১৬টি সড়ক। উপজেলার ১৮ ইউনিয়নের এসব অভ্যন্তরীণ ৫১ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা একেবারেই বেহাল। কোন কোন সড়কে বড় ধরনের গভীর খাদও সৃষ্টি হয়েছে বন্যার পানির ধাক্কায়। অবশ্য যেসব সড়কে ছোটখাটো ক্ষতি হয়েছে তা বালি ও ইটের টুকরো ফেলে কোনমতে যান চলাচলের জন্য সচল রাখা হলেও দুর্ভোগ কমছে না স্থায়ীভাবে মেরামত না হওয়ায়।
তবে এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী দপ্তর সূত্র জানিয়েছেন, পর পর দুইবারের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষত–বিক্ষত হয়ে যাওয়া গ্রামীণ অবকাঠামোর ক্ষতির চিত্র ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। এখনো প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় সহসা এসব সড়ক পুরোপুরি মেরামত করা যাচ্ছে না। অবশ্য বরাদ্দ পাওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত তদবির এবং যোগাযোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে।
জানা গেছে, দুইদফা ভয়াবহ বন্যায় সড়ক ও জনপথ বিভাগসহ বিভিন্ন দপ্তরের অভ্যন্তরীণ অসংখ্য সড়ক বেহাল অবস্থায় পড়ে রয়েছে। শুধুমাত্র সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতাধীন উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ৫টি সড়কের প্রায় ৩০ কিলোমিটার অংশ ভেঙে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। তন্মধ্যে বেশ কয়েকটি সড়কে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য বড় বড় গর্ত ও খানা–খন্দ। বন্যার পর চকরিয়া সড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে ৫টি সড়কের অধীন সম্পূর্ণ এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে কক্সবাজার সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন প্রশাসনে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। কিন্তু একমাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এসব সড়ক সংস্কারে কোন ধরনের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এতে মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে।
একই অবস্থা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরেরও (এলজিইডি)। এই দপ্তরের ১৬টি সড়কের প্রায় ৫১ কিলোমিটার অংশের মধ্যে অন্তত ৩০ কিলোমিটার সড়ক একেবারে নাজুক অবস্থায় বিদ্যমান রয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদনটি পাঠানোর ইতোমধ্যে একমাস অতিবাহিত হলেও এখনো ক্ষতিগ্রস্ত এসব সড়ক মেরামতে কোন ধরনের উদ্যোগ নেয়নি সড়ক বিভাগ। এ অবস্থার কারণে বর্তমানে কক্সবাজার–চট্রগ্রাম মহাসড়ক, বরইতলী মগনামা সড়ক,চিরিঙ্গা–বদরখালী–মহেশখালী সড়ক, টৈটং থেকে লালব্রিজ পর্যন্ত এবিসি সড়ক (আঞ্চলিক মহাসড়ক), চিরিঙ্গা জনতা মার্কেট–বেতুয়াবাজার–বাঘগুজারা সড়ক, ইয়াংছা–মানিকপুর–শান্তিবাজার সড়ক, জিদ্দাবাজার–মাঝেরফাঁড়ি সড়ক, একতা বাজার–পহরচাঁদা সড়কসহ বেশিরভাগ সড়ক চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফলে এসব সড়ক দিয়ে সব ধরনের যানবাহন ও জনসাধারণ চলাচলে অবর্ণণীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। অপরদিকে এলজিইডির নিয়ন্ত্রণাধীন প্রপার কাকারা থেকে মেনিবাজার পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল ইসলাম ছিদ্দিকী সড়ক, চিরিঙ্গা–মানিকপুর সড়ক, ছিকলঘাট–কৈয়ারবিল সড়ক, চিরিঙ্গা–বরইতলী–মগনামা সড়ক, চিরিঙ্গা–জনতা মার্কেট–বেতুয়াবাজার সড়ক, পৌরসভার আবদুল বারী পাড়া সড়কের অবস্থা বেশি করুণ। টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানির ধাক্কায় একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় এসব সড়ক।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ চকরিয়া কার্যালয়ের উপ–সহকারী প্রকৌশলী (এসও) আবু আহসান মো. আজিজুল মোস্তফা বলেন, ‘চলতি বর্ষামৌসুমের লাগাতার ভারি বর্ষণ ও মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে চকরিয়া সড়ক বিভাগের অধীন কক্সবাজার–চট্রগ্রাম মহাসড়কসহ বেশ কয়েকটি সড়কের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এসব সড়কের মধ্যে যেগুলো বেশি ক্ষতি হয়েছে তা পুরোপুরি মেরামত করা যায়নি। অবশ্য যেসব সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা যানবাহন চলাচলের জন্য উপযোগী করে তোলা হয়েছে। আর যেসব সড়কে ছোট–খাটো খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে তা মেরামত করে ফেলা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বেশি ক্ষতি হওয়া সড়কগুলোও অচিরেই পুরোপুরি মেরামত করে ফেলার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে তোড়জোড় চলছে। তবে প্রয়োজনীয় অর্থবরাদ্দ ছাড় না হওয়ায় আপাতত সংষ্কার কাজ বন্ধ রয়েছে।’
এ ব্যাপারে সড়ক ও জনপথ বিভাগ কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী রানাপ্রিয় বড়ুয়া বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামতে ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় অর্থবরাদ্দ চেয়ে উর্ধবতন প্রশাসনের কাছে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। তারপরও আমাদের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে কক্সবাজার–চট্রগ্রাম মহাসড়ক, চিরিঙ্গা–বদরখালী সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশে মেরামত কাজ করা হচ্ছে। তবে অর্থবরাদ্দ নিশ্চিত হলেই চকরিয়া উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক সড়ক মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
অপরদিকে কাকারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শওকত ওসমান বলেন, ‘প্রথম বন্যার ধাক্কাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া এলজিইডির নিয়ন্ত্রণাধীন মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল ইসলাম ছিদ্দিকী সড়ক স্থায়ীভাবে মেরামত করা যায়নি। এতে মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে গেছে। এছাড়া ইউনিয়নের আরো কয়েকটি সড়কের অবস্থাও বেহাল। তাই অতিদ্রুত এসব সড়ক পুরোপুরি মেরামত করে মানুষের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জালাল আহমদ সিকদার বলেন, ‘পর পর দুইবারের ভয়াবহ বন্যায় মাতামুহুরী নদীতীরের ইউনিয়ন বরইতলীর ৪টি সড়কের অবস্থা বেশি করুণ। এসব সড়কের বিভিন্নস্থানে গভীর খাদের সৃষ্টি হয়েছে বন্যায়। এখনো কয়েকটি সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করা যায়নি। এই অবস্থায় মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে গেছে।’
সুরাজপুর–মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম বলেন, ‘ভয়াবহ বন্যা ও লাগাতার ভারী বর্ষণে চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে চিরিঙ্গা–মানিকপুর সড়কের ফাইতং ছড়ার ওপর নির্মিত সেতুটি। এই সেতুটির দুই দিকে এপ্রোচের বিশাল অংশ ছড়ায় বিলীন হয়ে চরম ঝুঁকির মুখে পড়ায় খুঁটি দ্বারা স্পার এবং বালির বস্তা ফেলে যানবাহন চলাচল করছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এই চেষ্টায় সাময়িকভাবে যান চলাচল করা গেলেও স্থায়ীভাবে সড়কটি এই অংশ মেরামত করতে না পারলে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দেবে সড়কটিতে। তাই জরুরীভিত্তিতে এই সড়কটি পুরোপুরি মেরামত করার দাবি জানাচ্ছি।’
চকরিয়া–পেকুয়া উন্নয়ন ফোরামের চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান চৌধুরী মানিক বলেন, ‘কৈয়ারবিল ইউনিয়নটি মাতামুহুরী নদীর তলদেশের সঙ্গে সমান্তরাল। তাই বন্যার প্রথম ধাক্কার পানি পুরো কৈয়ারবিলকে আঘাত করে। এতে প্রতিবছর সড়কগুলো বড় বড় গভীর খাদে পরিণত হয়। তাই মাতামুহুরী নদীর চলমান ড্রেজিং প্রকল্পের আওতায় নদীর দুইতীর সিসি ব্লক দ্বারা টেকসইভাবে সংরক্ষণ না করলে এই অবস্থা থেকে মুক্তি মিলবে না। একই অবস্থার কথা জানালেন লক্ষ্যারচর, হারবাং, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নসহ ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়নগুলোর জনপ্রতিনিধিরা।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) চকরিয়া উপজেলা প্রকৌশলী কার্যালয় সূত্র জানায়, চলতি বর্ষা মৌসুমের প্রথম বন্যায় এলজিইডি নিয়ন্ত্রণাধীন চকরিয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ১৬টি অভ্যন্তরীণ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি সড়ক একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়ায় চলাচল অনুপযোগী অবস্থায় রয়েছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরিত হিসেব অনুযায়ী উপজেলায় এলজিইডির নিয়ন্ত্রণাধীণ এসব সড়কের প্রায় ৫১ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকার অংকে প্রায় ২২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এ ব্যাপারে এলজিইডি চকরিয়া উপজেলা প্রকৌশলী রণি সাহা বলেন, ‘বন্যায় এলজিইডির নিয়ন্ত্রণাধীন যেসব সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার চিত্রসহ ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত প্রয়োজনীয় অর্থবরাদ্দ না পাওয়ায় স্থায়ীভাবে এসব সড়ক মেরামতকাজ শুরু করা যায়নি। অবশ্য যেসব সড়ক ছোট–খাটো ক্ষতি হয়েছে তা জরুরী বরাদ্দ থেকে মেরামত করে দেওয়া হয়েছে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরুদ্দীন মুহাম্মদ শিবলী নোমান বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার অভ্যন্তরীণ সড়ক তথা গ্রামীণ অবকাঠামো যাতে অতিদ্রুত চলাচল উপযোগী করা যায় সেজন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছি।’
চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি জাফর আলম বলেন, ‘দুইবছর আগে সংঘটিত কয়েকদফা ভয়াবহ বন্যায় লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো যথাযথভাবে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করায় মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিল। কিন্তু এবারের বন্যার প্রথম ধাক্কায় সেই সড়কগুলো ফের লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। তাই অতিদ্রুত এসব সড়ক পুরোপুরি সচল করতে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
পাঠকের মতামত: